আমাদের মহাবিশ্বে জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য রহস্যময় বস্তু। এর মধ্যে কিছু রহস্য আবিষ্কৃত আর বেশি ভাগ সম্পর্কে মানুষের আজও কোনো ধারণা নেই। মহাকাশের এমনি এক চমকপ্রদ রহস্যের নাম নীহারিকা বা নেবুলা (Nebula)। নেবুলা শব্দের অর্থ মেঘ। এটি অসংখ্য স্বল্পলোকিত তারকার আম্ভরণ নিয়ে গঠিত হয়। এদের আকার বিচিত্র। ধূলিকর্ণা, হাইড্রোজেন গ্যাস ও প্লাজমা দ্বারা গঠিত আন্তঃনাক্ষত্রিক মেঘই হচ্ছে এই নীহারিকা। আর এই নীহারিকা হলো নক্ষত্র ও তারার জন্মস্থান। এখান থেকেই জন্ম নেই এরা। এক্ষেত্রে গ্রাভিটি ধূলিকণা এবং অন্যান্য গ্যাসীয় কণাগুলো একত্রিত হয়ে ধীরে ধীরে গঠন করে নক্ষত্র এবং তারা।

আবার অনেক নেবুলার সৃষ্টিও এই নক্ষত্র ও তারা থেকেই। অল্প জীবনকালের কিছু ভারী নক্ষত্রের জীবন শেষ হয় বিশাল এক বিস্ফোরণের মাধ্যমে। এধরনের নক্ষত্রকে বলে সুপারনোভা। সুপারনোভা বিস্ফোরণের ফলে তারার বাইরের অংশ, ধুলো, গ্যাস আর বিপুল পরিমাণ শক্তি অবমুক্ত করে। বিস্ফোরণের ফলে যে শক্তি নির্গত হয়, তা আশেপাশের গ্যাসগুলোতে আয়নিত করে ফেলে। তখন পুরো এলাকাটিকে উজ্জ্বল দেখায়। এভাবে সুপারনোভার ধ্বংসস্তুপ থেকে জন্ম হয় এই নীহারিকার।
প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আমাদের ছায়াপথ আকাশগঙ্গা বা মিল্কিওয়ের বাহিরের সব ছায়াপথকে নীহারিকা মনে করত। প্রযুক্তির প্রসারণ ও পরবর্তীতে শক্তিশালী টেলিস্কোপ আবিষ্কারের পর জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ধারণা পাল্টে যায় ও তারা পর্যবেক্ষন করেন আমাদের প্রতিবেশি ছায়াপথ গুলো নীহারিকা নয়। ২৬ নভেম্বর ১৬১০ সাল, ফরাসি জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিকোলাস ক্লদ ফাবরি টেলিস্কোপ দ্বারা প্রথম কালপুরুষ নীহারিকা আবিষ্কার করেন। এরপর আরো অনেক জ্যোতির্বিদ বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন নীহারিকা আবিষ্কার করেন। আমরা এখন কয়েকটি নাহারিকা সম্পর্কে জানব।
কয়েকটি নাহারিকা
কালপুরুষ নীহারিকা (Orion Nebula)

এটি মেঘ, গ্যাস ও ধূলিকর্ণা দ্বারা গঠিত মিল্কিওয়ের দক্ষিনে অবস্থিত বিকীর্ণ নীহারিকা যা অন্যতম উজ্জ্বল নীহারিকা। কালপুরুষ রাতের আকাশে খালি চোখে দেখা যায়। এর অবস্থান ১৩৪৪+/-২০ আলোকবর্ষ দূরে। এটি পৃথিবীর নিকটবর্তী বড় তারা গঠন অঞ্চলে অবস্থিত। এই নীহারিকা অনুমান করা হয়েছে ২৪ আলোকবর্ষ জুড়ে। কালপুরুষ নীহারিকাটি রাতের আকাশে সর্বোচ্চ যাচাইকৃত। তারা ও পৃথিবীর গঠন সম্পর্কে কালপুরুষ নীহারিকা অনেক তথ্য প্রকাশে সহায়তা করেছে।
১৬১০ সালে এটি আবিষ্কারের পর ফেহান ব্যস্পটিস্ট নামক এক ব্যক্তি ১৬১৮ সালে এটি পর্যবেক্ষণ করেন ও এই নাহারিকা সম্পর্কে ১৬৫৯ সালে পুরোপুরি তথ্য জানা যায়। ক্রিশ্চিয়ান হওজেন নামক আরেক জ্যোতিবিদ এই সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা করেন। এর আগে পুরাতন গ্রন্থ গুলোতে কালপুরুষ নীহারিকাকে “গ্রেট নীহারিকা” বা “গ্রেট কালপুরুষ নীহারিকা” বলা হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায় নীহারিকা সম্পর্কে আমাদের ধারণা প্রাচীন।
বুমেরাং নীহারিকা (Boomerang Nebula)

বুমেরাং অর্থ বাঁকা তীর বা ক্ষেপণাস্ত্র। এটি একটি প্লেটোপ্লানেটারি নীহারিকা যা পৃথিবী থেকে ৫,০০০ আলোকবর্ষ দূরে সেন্টারাস নক্ষত্রমন্ডলে অবস্থিত। একে বোটাই নীহারিকাও বলা হয়ে থাকে। এটিকে একটি নক্ষত্র ব্যবস্থা হিসেবে ধরা হয় যা প্লানেটারি অবস্হায় গ্রহের দশার চতুর্দিকে পাক খাচ্ছে। এর অভ্যন্তরীন গ্যাসের নিঃসরণের ফলে এর গঠন প্রক্রিয়া চলছে যেখানে একটি নক্ষত্র পরবর্তী জীবনে ভর হারিয়ে আলো বিকিরিত করতে থাকে। এই গ্যাসের বহির্গমনের বেগ প্রায় ১৬৪ কিমি/সেকেন্ড এবং ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে কারণ তা মহাশূন্যে হারিয়ে যাচ্ছে; এই গ্যাসের বহির্গমনই নীহারিকার এত কম তাপমাত্রা কারণ।
১৯৮০ সালে জ্যোতিবিদ কেইথ টেইলর ও মাইক স্কারট অ্যাংলো-অস্ট্রেলীয় নভোবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে একে পর্যবেক্ষণপূর্বক “বুমেরাং নীহারিকা” নাম দেন। ১৯৯৮ সালে হাবল টেলিস্কোপ ব্যবহার করে একে পরিষ্কার দেখা যায় এবং তখন একে অনেকটা প্রতিসম বালিঘড়ি আকৃতির ন্যায় দেখায়। বুমেরাং নীহারিকার দৃশ্যমান দ্বৈত লোব একটি বৃহৎ ঠান্ডা গ্যাসের বর্তুল ভলিউম দ্বারা বেষ্টিত যা কেবল সাব-মিলিমিটার রেডিও তরঙ্গদৈর্ঘ্য ব্যবহার করেই দেখা যায়। কেন্দ্রের তারার আলো নীহারিকার ধূলিকনার উপরে প্রতিফলিত হয়ে আলোকিত হয়ে উঠে। এটি এই পর্যন্ত জানা সবচেয়ে দুরের শীতলতম স্থান।
হেলিক্স নীহারিকা (Helix Nebula)

হেলিক্স নীহারিকার অবস্থান পৃথিবী থেকে প্রায় ৭০০ আলোকবর্ষ দূরে। এই নীহারিকাটি সমস্ত উজ্জ্বল গ্রহের সাপেক্ষে পৃথিবীর নিকটে অবস্থিত। “আই অব গড” নামে পরিচিত এই নীহারিকার বয়স ৯,৪০০ থেকে ১২,৯০০ বছর। ২.৮৭ আলোক বর্ষ ব্যসার্ধের এই নীহারিকা ভেতরের অংশ সেকেন্ডে ৪০ কিমি ও বাইরের অংশ সেকেন্ডে ৩২ কি.মি হারে প্রসারিত হচ্ছে। ১৮২৪ সালে জ্যোতিবিদ কার্ল লুডিগ হারডিং এই নীহারিকা আবিষ্কার করেন। “ঈশ্বরের চোখ” হিসাবে পরিচিতির পাশাপাশি নীহারিকাটি “আই অফ স্যারন” নামেও পরিচিত।
গ্রহ নীহারিকা (Planetary Nebula)

এটি এক গ্যসীয় নীহারিকা। শ্বেত বামন তারা হওয়ার ঠিক আগে তারাটি লোহিত দানবে পরিনত হয়। এই লোহিত দানব তারাই তার বহির্ভাগ মহাকাশে নিক্ষেপ করে, আর অন্তর্ভাগ সংকুচিত হয়ে শ্বেত বামন গঠন করে। মহাকাশে নিক্ষিপ্ত ঐ গ্যাসই গ্রহ নীহারিকা গঠন করে। গ্রহ নীহারিকা আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যমে অনেক রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে। ছায়াপথের রাসায়নিক গঠন ও বিবর্তন বিষয়ে ধারণা পাওয়া এর অধ্যায়ন জরুরি
এছাড়াও অন্য ছায়াপথের তথ্য লাভের ক্ষেত্রে এদের অবদান অনস্বীকার্য। এটি প্রথম ১৭৬৪ সালে চার্লস মেসিয়র পর্যবেক্ষণ করেন ও এম ২৭ তালিকাভূক্ত করেন পরে ১৭৮০ সালে উইলিয়াম হার্শেল তার টেলিস্কোপে এটি অবিষ্কার করেন। এই নীহারিকাটি অনেরটাই ইউরেনাস গ্রহের অনুরূপ। তাই এটিকে গ্রহ নীহারিকা বলা হয়ে থাকে।
লেগুন নীহারিকা (Lagoon Nebula)

এম৮ তালিকাবদ্ধ ধনু নক্ষত্রমন্ডলীতে অবস্থিত একটি জায়ান্ট ইন্টারস্টেলার মেঘ। এটি ৪১০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত ও ৫৫×২০ আলোকবর্ষ ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট। লেগুন নীহারিকা ১৬৫৪ সালে জ্যোতিবিজ্ঞানী জিওভান্নি সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন। এই নীহারিকাটি খালি চোখে পর্যবেক্ষণ করা যায়। আকাশের মধ্য-উত্তর অক্ষে তাকালে এই নাহারিকাটি দেখা যায়। টেলিস্কোপে এর আকার অনেকটা ডিম্বাকৃতির! পৃথিবীর আকাশে ৯০’ থেকে ৪০’ পর্যন্ত বিস্তৃতি পরিলক্ষিত হয় যা থেকে বোঝা যায় এর অবস্থান মোটামুটি ১১০ থেকে ৫০ আলোকবর্ষ পর্যন্ত। মানুষের চোখ এই রঙের প্রতি খুব কম সংবেদনশীল হওয়ায় টেলিস্কোপ বা বাইনোকুলার দিয়ে পর্যবেক্ষ করলে নীহারিকাটি ধূসর দেখায়।
এছাড়াও মহাকাশের গ্যালাক্সি গুলো জুড়ে রয়েছে আরো অনেক ধরণের নীহারিকা। যাদের কথা বললে শেষ হবে না। এই রহস্য ঘেরা আকর্ষণ আমাদের ভাবিয়েছে প্রাচীন যোগ থেকে আজকের দিন অবধি। এখনো হয়ত কেউ নতুন নীহারিকার সন্ধানে মহাকাশের দিকে টেলিস্কোপ কাত করে রেখেছে। আমাদের প্রযুক্তি আরো যত উন্নত হবে মহাবিশ্বের রহস্য গুলো তত তারাতারি উৎঘাটিত হবে। নীহারিকা নিয়ে হয়ত জ্যোতির্বিজ্ঞানে আরো নতুন দ্বার উন্মচিত হবে।
তথ্যসূত্র ও ছবি: ইন্টারনেট