কোথায় মানুষের পা পড়েনি – মহাসাগরের অতলে, দূর্গম এভারেস্ট কিংবা আমাজন সবখানেই পৌঁছে গেছে মানুষের পায়ের ছাপ । কিন্তু মঙ্গল আজও রয়ে গেছে অজেয়। এবার সেই মঙ্গলে কেবল মানুষের পা রাখা নয়, স্থায়ী মানব বসতি স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে নেদারল্যান্ড ভিত্তিক একটি অলাভজনক সংস্থা। এই প্রকল্পটির নাম দেয়া হয়েছে মার্স ওয়ান, অলাভজনক সংস্থাটির নামও মার্স ওয়ান (Mars One)। মঙ্গলযাত্রায় একমুখী টিকেট এটি।
মার্স ওয়ান: মঙ্গল গ্রহে স্থায়ীভাবে মানব বসতির অভিযান

বর্তমানে মঙ্গল থেকে রকেট উৎক্ষেপণের সুযোগ নেই। তাই এই অভিযানে যারা যাবেন, তাদের সেখানেই থেকে যেতে হবে। পৃথিবীর সময়তে যেন মৃত্যু ঘটবে তাদের। হয়ত পথিকৃতের ভুমিকার বা মানব কল্যাণে আত্মত্যাগের কারণে একদিন মঙ্গলের বুকে তাদের ভাস্কর্য তৈরি হবে।
মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল স্যাগান স্বপ্ন দেখেছিলেন, মঙ্গলে একদিন মানুষ স্থায়ী বসতি স্থাপন করবে। তার সে স্বপ্ন যেন পূরণ হতে চলেছে মার্স ওয়ানের মাধ্যমে। ২০১২ সালে মার্স ওয়ান তাদের পরিকল্পনা প্রথমবারের মত প্রকাশ করে। শুরুতে পরিকল্পনা ছিল ২০২৩ সাল নাগাদ মঙ্গলে মানববসতি স্থাপনের কাজ শুরু হবে, এখন সেটা পিছিয়ে ২০২৫ করা হয়েছে। ২০২৪ সালে ২ জন পুরুষ ও ২ জন নারী – মোট চারজনের দলটি পৃথিবী ছেড়ে যাবে মঙ্গলের উদ্দেশ্যে আর সেখানে পৌঁছাবে ২০২৫ সালে। মার্স ওয়ান জানিয়েছে, এই পরিকল্পনা প্রণয়নে দীর্ঘ ১২ বছর সময় নিয়েছেন তারা।

পৃথিবীর আবহাওয়ার সাথে মঙ্গলের পার্থক্য বিস্তর। পৃথিবীর সবচেয়ে নিকটতম গ্রহ মঙ্গলের ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের প্রায় অর্ধেক, ঘনত্বও বেশ কম। মঙ্গলের আয়তন পৃথিবীর মাত্র ১৫%, ঘনত্ব ১১% আর আকর্ষণ বল ৩৮% এর কাছাকাছি। আয়রন অক্সাইডের আধিক্যের কারণে এর মাটির বর্ণ অনেকটাই লালচে। আকর্ষণ বল কম হওয়ার কারণে বায়ুমন্ডল প্রায় নেই বললেই চলে। মঙ্গলগ্রহে পৃথিবীর মত কোন চৌম্বকক্ষেত্র নেই। সূর্য এবং অন্যান্য উৎস থেকে আসা মহাজাগতিক রশ্নি সরাসরি মঙ্গল পৃষ্ঠে আঘাত করে। সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে মঙ্গলের সময় লাগে ৬৮৭ দিন। আর পৃথিবীর ২৪ ঘন্টা ৩৯ মিনিটে মঙ্গল গ্রহে একদিন হয়।
অনেকেই মঙ্গলে গেলে আর ফেরা যাবে না এই সত্যটি ছাড়া আরও কিছু যুক্তি দিচ্ছেন, যার কারণে মঙ্গলে যেতে তারা অন্যদের নিরুৎসাহী করতে চাইছে। মার্স ওয়ানের উদ্যোক্তারাও মানছেন অভিযানটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সামান্যতম ভুল, কারিগরি ত্রুটি বা অপ্রত্যাশিত কোন পরিস্থিতি পুরো অভিযানকে ব্যর্থ করে দিতে। প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হওয়ার পর ৮ বছর ধরে অভিযাত্রীদের প্রশিক্ষণ নিতে হবে। এর মধ্যে বড় একটা সময় কাটাতে হবে কৃত্রিমভাবে তৈরি প্রতিকূল পরিবেশে, বাইরের পৃথিবী থেকে একদমই বিচ্ছিন্ন থাকবেন তারা।

যারা ব্যাক্তিজীবনে অন্তর্মুখী, তাদের জন্য অস্বস্তির খবর হচ্ছে ব্যক্তিগত জীবন বলে এখানে কিছু থাকবে না। প্রতিটি ঘটনা ২৪/৭ ঘন্টা পৃথিবীতে প্রচারিত হবে – রিয়্যালিটি শো বলে কথা! ৫০ বর্গমি. একটি কোয়ার্টার পাবেন একজন অভিযাত্রী, যা একটি সাধারণ হোটেল কক্ষের চেয়ে কিছুটা বড়। রকেটের মধ্যে অত্যন্ত সীমিত জায়গায় প্রায় ৮ মাস কাটাতে হবে চার অভিযাত্রীকে। আর সৌর ঝড়ের মত কোন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি যদি তৈরি হয় তাহলে আরও কম সময় সেখানে কাটাতে হবে তাদের। মঙ্গলের আকর্ষণ বল পৃথিবীর তুলনায় বেশ কম, কোন একদিন মঙ্গল থেকে ফিরে আসলে এই অভিযাত্রীরা পৃথিবীর আকর্ষণ বলের সাথে আবার মানিয়ে নিতে পারবে কিনা সেটা নিয়েও সংশয় করছেন অনেকে।
কিন্তু এসব যুক্তি একদমই দমাতে পারেনি আগ্রহী অভিযাত্রীদের। পৃথিবীর ১৪০টি দেশ থেকে দুই লাখের বেশি আবেদন জমা পড়েছে এই অভিযানের জন্য। তারা বলছেন, মানুষ প্রথমবারের মত মঙ্গলে বসতি স্থাপন করতে চলেছে এমন একটি প্রকল্পে অংশ নিতে পারাটাই হবে সৌভাগ্যের বিষয়। তাদের ভাবছেন মানবজাতীর ভবিষ্যৎ মঙ্গলেই যেন নিহিত আছে!

বসতি স্থাপনকারীদের দলটি যাওয়ার আগে আরও ছয়টি মিশন মঙ্গলে যাবে মানববসতির অবকাঠামো তৈরির উদ্দেশ্যে, বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করবার জন্য। সেখানে বাতাসভর্তি এক ধরনের আবাসস্থলে তারা থাকবেন। অতি তেজস্ক্রিয়তার কারণে মঙ্গলের বুকে তাদের হাঁটাহাঁটি করতে হবে বিশেষ এক ধরনের স্পেসস্যুট পরে। প্রথম এই চার অভিযাত্রীর জন্য খাবার, ওষুধ, যোগাযোগের যন্ত্রপাতি ইত্যাদি পাঠানো হবে পৃথিবী থেকে। সেখানে দুই থেকে তিনটি কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপন করা হবে পৃথিবীর সাথে যোগাযোগের জন্য, লাইভ ফিডের সাহায্যে পৃথিবীর সাথে ২৪/৭ ঘন্টা যোগাযোগ থাকবে। প্রতি ২বছর পরপর সেখানে নতুন দল যোগ দেবে।
চাঁদের অভিযান বিজয়ী নাসার নভোচারী বাজ অলড্রিন বলেছেন, ২০৩৫ সাল নাগাদ মঙ্গলে মানববসতি দেখতে পেলে তিনি খুশিই হবেন কিন্তু তাঁর মনে হয় না এই প্রকল্প সর্বপ্রথমে সে লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে। অন্যদিকে কারিগরি এবং আর্থিক বিবেচনায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নযোগ্য কিনা সেটা নিয়ে বিতর্ক আছেই। যাদের কোন নিজস্ব মহাকাশযান নেই, রকেট উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা নেই – তারা মঙ্গলে মানুষ পাঠাবে এটি অনেকই মানতে পারছেন না। বরং চাঁদে জমি বিক্রির মতই চটকদার ভাওতাবাজি প্রকল্প মনে করছেন তারা!
জার্মান নভোচারী ওয়াল্টার এই প্রকল্পের কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, বর্তমান প্রযুক্তিতে মঙ্গলে অভিযাত্রীদের জীবিত পৌঁছানোর সম্ভাবনা মাত্র ৩০ ভাগ। আর মঙ্গলে পৌঁছাতে পারলে সেখানে ৩ মাসের বেশি বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ২০%’র কম। তিনি বলছেন মানুষের জীবনের কোন মূল্য প্রকল্প কর্তাদের কাছে নেই, কেবল টেলিভিশন রিয়েলিটি শো থেকে টাকা আয়ই তাদের উদ্দেশ্য।

হয়ত শুনেছেন, বাংলাদেশী মেয়ে লুলু ফেরদৌস এই ৪ অভিযাত্রীর একজন। হয়ত সেকারণে এদেশের মানুষেরও চোখ থাকবে এই অবধারিত মৃত্যু অভিযানের দিকে। লুলু ফেরদৌসদের অভিযানই বলে দিবে মানুষ কি আসলেই মঙ্গলের বুকে নিজের বাসা বানাতে পারবে কিনা!
লেখক: Abid Reza